ঢাকা | মঙ্গলবার | ২রা ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১১ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

হাসপাতালে বেওয়ারিশ মৃতদেহ, অবহেলায় মৃত্যু জহর রায়ের

বাংলা সিনেমার কিংবদন্তি অভিনেতা জহর রায় একজন অসাধারণ শিল্পী ছিলেন। স্বর্ণযুগের বলি তথাকথিত তারকা, তিনি ছিলেন একাধারে নাট্যকার, চলচ্চিত্র অভিনেতা এবং একজন চিত্রনাট্যকার। একসময় তিনি টলিউডের সর্বেসর্বা নাম ছিলো, তাঁর অভিনয় গুণে দর্শকের মন জয় করেছিলেন। তবে 시간이 গড়ানোর সাথে সাথে তার জীবনে অন্ধকার নামে, চলচ্চিত্রাঙ্গনের বিশৃঙ্খলা আর ব্যক্তিগত জীবন সংকটের কারণে তিনি একা হয়ে পড়েন। তার শেষ জীবনে দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়িয়েছিলেন, অবহেলার শিকার হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢুকেছেন। তার পরিণতি কেমন হয়েছিল তা আর কেউ ভাবতে পারেনি।

জহর রায় ১৯১৯ সালে বরিশালের মহিলারায় এক বাঙালি বৈদ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সতু রায় ছিলেন নির্বাক যুগের একজন জনপ্রিয় অভিনেতা। জন্মগতভাবেই তার অভিনয়প্রতিভা ছিল চোখে পড়ার মতো। স্বজনের মুখে শুনে তিনি ছোট থেকে বড় অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। তবে পারিবারিক আর্থিক কষ্টের কারণে স্কুলের পড়াশোনা বেশিদূর এগিয়ে নিতে পারেননি। তবুও, অভিনয় তাঁর আত্মার গভীরে গেঁথে গিয়েছিল। তিনি শুরু করেছিলেন অ্যামিচার থিয়েটার দিয়ে, সেখানে তিনি চার্লি চ্যাপলিনের ভক্ত ছিলেন।

আরও অর্থনৈতিক সংকটে তিনি দর্জির দোকানও খুলেছিলেন। তবে দীর্ঘ সময় অবধি সংসার চালাতে গিয়ে তার মধ্যে অভিনয়ে ফিরে আসার প্রবল বাসনা জেগে ওঠে। তাই তিনি সবকিছু উপেক্ষা করে কলকাতার সিনেমা জগতে পা রাখলেন। শুরুতে তিনি ছোটখাটো নানা চরিত্রে অভিনয় করতেন। তবে বড় ব্রেক পান বিমল রায়ের সিনেমা ‘অঞ্জনগড়’-এ, যা তাকে মূলধারার সিনেমায় প্রবেশের সুযোগ করে দেয়। এরপর ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে তার জুটি দর্শকদের ব্যাপক পছন্দ হয়।

অভিনেতা ভানুর সঙ্গে ‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট’ চরিত্র নিয়ে তার জনপ্রিয়তা একদম শীর্ষে চলে যায়। এর পাশাপাশি ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’, ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘পরশপাথর’, ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’সহ অন্য ছবিগুলিতে অভিনয় করে শিল্পী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তবে তার ব্যক্তিগত জীবন সুখের ছিল না। নিজের পরিবারের জন্য জহর রায় সংগ্রাম চালিয়েছিলেন, কিন্তু মেয়ের মৃত্যু তার জীবনে গভীর আঘাত হানে।

প্রথম কন্যা জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়, যা তার জীবনকে একঅপরাধবোধের মধ্যে ঠেলে দেয়। শোকময় এই সময়ে তিনি মদ্যুপান শুরু করেন, যা ভবিষ্যতের জন্য নতুন সমস্যার জন্ম দেয়। এরপর তার চার সন্তান জন্মগ্রহণ করলেও প্রথম সন্তানকে হারানোর শোক তিনি সহ্য করতে পারেননি। দেখাশোনার অভাব, অর্থের সংকট এ সব তার জীবনকে আরও কঠিন করে তোলে। পরিবারে প্রয়োজনীয় সমর্থন না পেয়ে নানা সমস্যায় পড়েন তিনি। আর্থিকভাবে দিশেহারা হয়ে পড়ে তিনি।

অবশেষে ১৯৭৭ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে কেউই উচ্চপদে পৌঁছাতে পারেনি, বন্ধু হিসেবে কেবল ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন। বেশিরভাগ নেতিবাচক অবহেলায় ভাটি পড়েন তিনি, অথচ এর মধ্যেই একবার ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘এই দেশের কাছে কি সত্যিই জহর রায়ের কিছু পাওনা ছিল না? তিনি অন্য দেশে জন্মালে তো স্যার উপাধি পেতেন।’ আজও এই মহান শিল্পীর জন্মদিনে আমরা তাকে শৈশবের শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।