ঢাকা | মঙ্গলবার | ১৯শে আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৪ঠা ভাদ্র, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ২৫শে সফর, ১৪৪৭ হিজরি

বিপিএলে এক ম্যাচ হারাতে ৪০০ কোটি টাকা লোভের Betting চক্রের তদন্তে চাঞ্চল্যকর তথ্য

বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) স্পট ফিক্সিংয়ের তদন্তে হঠাৎ করে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। তদন্তের তথ্যে জানা গেছে, এক ফ্র্যাঞ্চাইজিকে নির্দিষ্ট একটি ম্যাচ হারের জন্য বিগ হারে অর্থের প্রস্তাব দেয় জুয়াড়িরা—প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এই প্রস্তাব প্রাপ্তির ব্যাপারটি ফ্র্যাঞ্চাইজির পক্ষ থেকে নির্দিষ্টভাবে জানানো হয়নি বলে তদন্ত কমিটি নিশ্চিত নয়। তবে, নিয়ম অনুযায়ী সেটি বিসিবির দুর্নীতি দমন ইউনিটকে জানানো হয়নি এবং সেখান থেকে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এর ফলে, ম্যাচটি হেরেই যায়।

সর্বশেষ, তিন সদস্যের স্বাধীন তদন্ত কমিটি বিসিবির একটি বিশেষ তদন্ত কাজ সম্পন্ন করেছে। আগামী সপ্তাহে তাদের প্রাথমিক রিপোর্ট সভাপতি আমিনুল ইসলামকে জমা দেয়ার কথা রয়েছে। এই কমিটিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন সাবেক বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার, আরও রয়েছেন আন্তর্জাতিক স্বীকৃত আইনজীবী ড. খালেদ এইচ চৌধুরী ও সাবেক ক্রিকেটার শাকিল কাসেম।

তদন্তের অংশ হিসেবে প্রায় ৩০০ ঘণ্টার কথোপকথনের রেকর্ড থেকে লিখিত ৩ হাজার পৃষ্ঠার বেশি ডেটা সংগ্রহ করা হয়েছে। এই ডিটেলেড ডেটা বিশ্লেষণে প্রাথমিক রিপোর্ট তৈরি হয়, যেখানে বিসিবিকে সতর্ক করতে নানা সুপারিশ রয়েছে। ড. খালেদ এইচ চৌধুরী বলেন, ‘প্রাথমিক রিপোর্টে মূলত আমাদের ফাইন্ডিংস তুলে ধরা হবে। কেন এসব ঘটছে, এর অবসান কিভাবে হবে, বিসিবির উচিত কি ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া—এসব বিষয়ে আমাদের পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ থাকবে।’

জানাগেছে, গত বিপিএলেই সন্দেহজনক অন্তত ৩৬টি ঘটনা ঘটেছে। তদন্তে অভিযুক্ত হিসেবে ১০-১২ জন ক্রিকেটারের নাম এসেছে, যার মধ্যে ৩-৪ জনের বিরুদ্ধে ‘হাই ফ্ল্যাগড’ অভিযোগ রয়েছে—অর্থাৎ, এসব প্রমাণের আকারে বেশ স্পষ্ট। এসব খেলোয়াড়ের মধ্যে দুজন সাবেক জাতীয় দলের ক্রিকেটার—একজন পেসার ও একজন অফ স্পিনার। এছাড়া, একজন অপ্রকাশিত জাতীয় দলের পেসার আছেন, যিনি অস্বাভাবিক ওয়াইড বল করে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি করেছিলেন। বাকিরা ‘মিডিয়াম ফ্ল্যাগড’ বা ‘লো ফ্ল্যাগড’—অর্থাৎ, অভিযোগটি পুরোপুরি প্রমাণিত না হলেও সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।

তদন্তে আরও উঠে এসেছে, শ্রীলঙ্কার শেষ সফরের দলে থাকা একজন ক্রিকেটার এবং একটি ফ্র্যাঞ্চাইজির কোচের নামও সন্দেহের তালিকায় রয়েছে। এমনকি, বিসিবির একটি সাবকমিটির একজন সদস্যের নামও এসেছে, যিনি গত বিপিএলে কোনও এক ফ্র্যাঞ্চাইনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। তদন্তে স্পষ্ট হয়েছে, দুটি ফ্র্যাঞ্চাইনের—দুর্বার রাজশাহী, সিলেট স্ট্রাইকার্স ও ঢাকা ক্যাপিটালস—স্পট ফিক্সিংয়ে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই পরিস্থিতিতে, কমিটি অপরাধীদের অপ্রমাণিত থাকলে তাদের সব ক্রিকেটীয় কর্মকাণ্ড থেকে আলাদা রাখার সুপারিশ করতে পারে বলে জানা গেছে।

তদন্তের সময় উঠে এসেছে, অনলাইন বেটিং বিজ্ঞাপন প্রচার করে একটি প্রতিষ্ঠান ১৭০ থেকে ১৮০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। কমিটির পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, এই ধরনের চ্যানেল ও সম্প্রচারকদের থেকে বিসিবিকে যেন দূরে রাখা হয়, কারণ তারা পরোক্ষভাবে ফিক্সিংয়ে জড়িত থাকতে পারে। পাশাপাশি, দেখা গেছে, বেটিং এজেন্টরা স্টেডিয়ামের করপোরেট বক্সে বসে খেলা দেখছে—যেখানে বিসিবির দুর্নীতি দমন ইউনিটের নজরদারি দুর্বল। বিদেশি এজেন্টদের নিরাপত্তা, থাকা ও যাতাযাতের নানা ব্যবস্থা এখানে করা হয়। এখন, কিছু স্থানীয় এজেন্টও এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে।

কমিটির তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরئی বিপিএল মিলিয়ে সন্দেহজনক প্রকারের ঘটনা মোট ১৪০টির বেশি। এর মধ্যে, নতুন করে সন্দেহভাজন খেলোয়াড়ের সংখ্যা ৬০ এর বেশি, যার অনেকের নাম বারবার উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে সুপারিশ হিসেবে থাকবে—বিসিবির দুর্নীতি দমন ইউনিটকে আরও শক্তিশালী করা, দেশের সব জাতীয় ও ঘরোয়া ক্রিকেট লিগে এই ইউনিট সক্রিয় রাখা, এবং অনলাইন বেটিং বন্ধে বর্তমান আইনের সংশোধন বা নতুন আইন প্রণয়নের প্রস্তাব। কমিটি মনে করে, আইনটি এমন হওয়া উচিত যাতে বিসিবিই দোষীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে।

তদন্তে কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। ফরেনসিক তদন্তের অভাবে অভিযুক্তদের ব্যাংক হিসাব খতিয়ে দেখা সম্ভব হয়নি। কমিটি অভিযোগ করে—বিসিবির দুর্নীতি দমন ইউনিট তাদের সহযোগিতা করেনি, পাশাপাশি আইসিসি বা অন্যান্য পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলোর সংশ্লিষ্ট তথ্যও পাওয়া যায়নি। এসব কারণে, ফরেনসিক তদন্তের প্রত্যাশা করা হচ্ছে।

চূড়ান্ত রিপোর্ট আগামী মাসে জমা দেওয়া হবে, যেখানে বিস্তারিত অভিযুক্তের নাম, সন্দেহজনক ঘটনাগুলি এবং প্রমাণাদি স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে।